ইরানী ভিসা যেন এক সোনার হরিণ

তুরস্কে প্রবেশে বাংলাদেশি সরকারী পাসপোর্টে 'অন এরাইভাল' আগমনে ভিসা দেয়া হয় তাই উড্ডয়নের প্রাক্কালে অগ্রিম ভিসা নেয়ার প্রয়োজন নেই! হামবুর্গের তুর্কী কনস্যুলেটে ইনফরমাশন টি জানতে পেরে খুব ভাল লেগেছিল। প্রথমবার ইস্তাম্বুল গিয়েছিলাম ১৯৮৯ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুই ভাগ হওয়া জগতখ্যাত জার্মানির পশ্চিম অংশ থেকে প্রাচীন সভ্যতা পারস্য সাম্রাজ্যের ঝাণ্ডাবাহী প্রতিনিধিত্বের দাবীদার ইরানে। ওখানে ডাক্তার হিসাবে তখন কর্মরত আমার ভাইয়ার কাছে। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে ইরান যাত্রা চূড়ান্ত করা ছিল হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিস্থ রাঁধার নাচ দেখার জন্য বারো মণ ঘি যোগাড়ের চেয়েও কঠিন। ঊনিশ শত সত্তর দশকের শেষ প্রান্তে ইরানি ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান- ইরাক যুদ্ধ ছিল টানা আট বছরঃ ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত। যুদ্ধবিরতি চুক্তির কিছু দিনের মধ্যে ১৯৮৯ সালের জুন মাসে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনির মৃত্যু, সব মিলিয়ে ইরানের ট্যুরিস্ট ভিসা প্রাপ্তি ছিল এভারেস্ট আরোহণের চেয়েও অনেক কঠিন। গন্তব্য যেহেতু ইরান তাই ইরানের ভিসা না পেলে জার্মান নেভী প্রদত্ত ৩০ দিনের ছুটি মাটি হওয়ার দুশ্চিন্তায় মনটা তিতা করলা।

আমি তখন উত্তর জার্মানির কীল শহরে অফেনবুর্গ জাহাজে ওয়াচকীপিং প্রশিক্ষণরত। জার্মান নেভীর ট্র্যাডিশন অনুযায়ী বিভিন্ন শহরের নামে ওদের যুদ্ধ জাহাজের নামকরণ করা হত। আর তেমনি অফেনবুর্গ শহরের নামে জাহাজটির নাম রাখা হয়েছিল। অফেনবুর্গ হল জার্মান প্রদেশ বাডেন- তুরটেমবেরগ এর অরটেনাওক্রাইস জেলার রাজধানী। আর কীল? ওটা জার্মান বালটিক সমুদ্র তীরের সুনসান সুন্দর বন্দর নগরী। ওয়াচকীপিং প্রশিক্ষণ পাইলটদের এককভাবে বিমান উড্ডয়নের মত এককভাবে জাহাজ চালানোর যোগ্যতা অর্জন। অফেনবুর্গের কমান্ডিং অফিসার মহোদয়কে বলে উইক এন্ড এর সাথে একদিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে নিকটস্থ হামবুর্গ শহরের ট্রেনে চড়লাম। উদ্দেশ্য ওখানকার ইরানিয়ান কন্সুলেট থেকে ভিসা নেওয়া। আমার জীবনে প্রথম কোন বিদেশী কনসুলেটে প্রবেশ। ইরানিয়ান কন্সুলেট অফিস লোকে লোকারণ্য। সবার উদ্দেশ্য ইরানের ভিসা নিয়ে ইরান ভ্রমণ। যুদ্ধ থেমে গেছে, তাই 'বসন্ত এসে গেছে' ভাবটা যেন এরকমই। কনস্যুলেটের ইরানী ভিসা অফিসার, আমার এনডিসি (ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স) কোর্সমেট তেহরানে পাঁচ বছর কাটানো বাংলাদেশ এম্বাসীর প্রাক্তন কমার্শিয়াল কাউন্সেলরের দেয়া ইরানী অপ্সরাদের নাম "ইরানের গোলাপ”, পর্যন্ত পৌঁছানোর পর আমার পাসপোর্ট কাগজ পত্র ঘেঁটে যা বলা হল তা এই যে আমি যেন মাস তিনেক পর ভিসা হয়েছে কিনা তার খবর নিতে আসি! আমি সবিনয়ে নিবেদন করলাম যে আমার ছুটি সর্বসাকুল্য ত্রিশ দিন। এর ভিতর আমাকে ভ্রমণ করে ফিরে এসে চাকুরীতে রিজয়েন করতে হবে। ভাব এবং ভাঁজ দুটো দিয়ে খুব বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার মিলিটারি চাকুরী! স্পেশাল কেস!

এবার হাতে নয়, সরাসরি হৃদয়ে গোলাপের কাঁটা ফুটল। উনি আমাকে বললেন, "আমাদের সফল ইসলামী বিপ্লবের বিরোধীরা এখনও সক্রিয় থাকায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে আপনার কাগজ পত্র আমরা প্রথমে তেহরান পাঠাবো। সেখান থেকে আপনার দেশে, রাজধানী ঢাকায় আপনার প্রদত্ত ইনফরমাশনের সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে, তিন মাসের মধ্যে সবকিছু ওকে হয়ে ফিরে আসলে আশা করতে পারেন আমরা আপনার ভিসা ইস্যু করবো।" উপ্স! এত দেখি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে খাইবারপাস পার হবার চেয়ে কম কিছু নয়! আমার সব ধরণের ফন্দি-ফিকির, অনুনয়-অনুরোধ, ভদ্র মহিলার চিত্তাকর্ষণ, বা হৃদয়স্পর্শ করার যাবতীয় স্মার্টন্যাস বিফলে গেলো। এক কথায় সম্পূর্ণ বৃথা ঠেকল। তখনও শুনিনি গোলাপ কাল রঙের বা অতিরিক্ত কাঁটাযুক্ত হয়। ঐ বয়সে আমিও তো আফ্রোদিতির ভক্ত। তাই ইরানী অপ্সরা কনস্যুলেটের ভিসা অফিসারকে "কণ্টকাকীর্ণ কালো গোলাপের" বেশী বকা দিতে পারিনি। বিক্ষিপ্ত চিন্তায় মনকে সান্তনা দিতে কষ্ট হচ্ছিল। মাত্র কয়দিনের মাঝে আমার দ্বিতীয় ভাতিজার জন্ম হবে বলে ভাইয়া চিঠিতে জানিয়েছেন তাকে দেখবনা? গতমাসে অফেনবুর্গ জাহাজে করে ফ্রান্স থেকে ঘুরে আসার সময় ভাবীর জন্য স্পেশাল গিফট কিনে এনেছি তা দিতে পারবোনা? কতদিন হয় ভাইয়াকে দেখিনা, তার মজার মজার গল্প আর 'Encyclopedic'-'বিশ্বকোষীয় আলোচনা থেকে বঞ্চিত হবো? কনসুলেটে ব্যর্থ বিফল হয়ে এসব বিক্ষিপ্ত চিন্তা মাথায়, আর বিষণ্ণ মন নিয়ে হামবুর্গ শহরে এলোমেলো ভাবে হাঁটছিলাম।


লেখকঃ আবু আমনুন সায়্যিদ।

সম্পূর্ণ লেখা পড়তে "DOWNLOAD PDF" বাট্‌নে এ ক্লিক করুন।